সুন্দরবনের পূর্ব বিভাগের চাঁদপাই রেঞ্জের গোলপাতা কুপের দায়িত্বপ্রাপ্ত কুপ কর্মকর্তার (সিও) বিরদ্ধে ব্যাপক দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। ৫০০ মণ ধারণ ক্ষমতাসম্পন্ন একটি গোলপাতার নৌকায় সর্বসাকুল্যে সরকারি রাজস্ব আসে পাঁচ হাজার ৬০০ টাকা। কিন্তু সেখানে প্রতিটি নৌকা থেকে বিভিন্ন অজুহাতে ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে আদায় করা হয়েছে ৯০ হাজার থেকে ৯৫ হাজার টাকা। এভাবে ২০০টি নৌকা থেকে দুই গোনে (দুই ট্রিপে) প্রায় চার কোটি টাকা উৎকোচ নিয়েছেন ওই কুপ কর্মকর্তা।
মৌসুম শেষে ফিরে আসা বাগেরহাটের শরণখোলার ভুক্তভোগী গোলপাতা ব্যবসায়ীরা সম্প্রতি এসব অভিযোগ করেন সাংবাদিকদের কাছে।
এদিকে, মোটা অংকের উৎকোচ দিয়ে ক্ষতির মুখে পড়া কিছু ব্যবসায়ী তাদের ক্ষতি পোষাতে ঝাড় উজাড় করে পাতা আহরণ করারও অভিযোগ রয়েছে। একটি ঝাড় থেকে পাতা কাটার সময় মাঝ পাতার (মাঝের কচি পাতা) পাশে ঝাড় রক্ষায় একটি পূর্ণাঙ্গ পাতা (ঠ্যাকপাতা) রেখে গোলপাতা আহরণের নিয়ম রয়েছে। কিন্তু সেই ঠ্যাকপাতা না রেখেই ঝাড়ের সমস্ত পাতা কাটা হয়েছে। এমনকি ৫০০ মণ ধারণ ক্ষমতাসম্পন্ন একেকটি নৌকায় বর্ধিত অংশ জোড়া দিয়ে দুই হাজার থেকে আড়াই হাজার মণ পাতা বোঝাই করে এনেছে। এভাবে ঝাড় ধ্বংস করে পাতা কাটার ফলে হুমকির মুখে পড়েছে গোলবন। উজাড় করে পাতা আহরণ করায় ওই সমস্ত গোলবনে পরবর্তী বছরে আর নতুন পাতা গজানোর সম্ভাবনাও নেই বলে কয়েকজন ব্যবসায়ী মন্তব্য করেছেন।
পাশপাশি কোটি কোটি হাতিয়ে নিয়ে সরকারি রাজস্ব ফাঁকিসহ গোলপাতার বন ও ব্যবসায়ীদের ক্ষতির মুখে ফেলেছেন ওই অসাধু কর্মকর্তা। লোকসানে পড়ে আগামাীতে ব্যবসা গুটিয়ে নেওয়ারও ঘোষনা দিয়েছেন কয়েকজন ব্যবসায়ী।
শরণখোলার উপজেলার গোলপাতা ব্যবসায়ী তৌহিদুল ইসলাম তালুকদার, ফুল মিয়া আড়ৎদার, সেলিম বেপারী, মতিয়ার রহমান, জাকির হোসেন হাওলাদার জানান, শরণখোলা রেঞ্জে গোলপাতার পারমিট বন্ধ হওয়ার পর থেকে তারা চাঁদপাই রেঞ্জ থেকে পাতা আহরণ করে ব্যবসা করে আসছেন।
এবছর ২৮ জানুয়ারি ও ২৮ ফেব্রুয়ারি দুই কিস্তিতে তাদের মতো সাতক্ষীরা, খুলনা, মোংলাসহ বিভিন্ন এলাকা ব্যবসায়ীরা কমপক্ষে ২০০ নৌকার গোলপাতা আহরণের পারমিট (অনুমোতি) পান। এতে সব মিলিয়ে একেক কিস্তিতে নৌকা প্রতি সরকারি রাজস্ব আসে পাঁচ হাজার ৬০০ টাকা। অথচ তাদের কাছ থেকে পারমিট দেওয়ার সময় ২৮হাজার, কুপ চেকিংয়ের নামে ২৬হাজার, ভালো গোলবন (ঘের) দেওয়ার নামে ১৫হাজার, বিএলসি বাবদ পাঁচ হাজার, ঘাট চেকিংয়ের নামে পাঁচ হাজার, সিটি কাটা (পারমিট হস্তান্তর) বাবদ দুই হাজার, অন্যান্য খরচের নামে আরো ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকা করে এই বিশাল অংকের টাকা নেওয়া হয়েছে।
ক্ষতিগ্রস্ত ওই ব্যবসায়ীরা জানান, কুপ কর্মকর্তা ওবায়দুল হক তার অফিসের বোটম্যান (বিএম) মিজানুর রহমানকে দিয়ে ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে এই টাকা আদায় করেছেন। অতিরিক্ত টাকার ব্যাপারে কোনো ব্যবসায়ী প্রশ্ন তুললে তাকে নানাভাবে হয়রানীর শিকার হতে হয়েছে। তাই লাখ লাখ টাকা পুজি খাটিয়ে লোকসানের ভয়ে বাধ্য হয়ে তাদেরকে নিয়মের অতিরিক্ত টাকা ঘুষ দিতে হয়েছে কুপ কর্মকতাকে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন ব্যবসায়ী জানান, অনেক বাওয়ালী ক্ষতি পোষাতে ৫০০মণের পারমিট নিয়ে নৌকায় অতিরিক্ত তক্তা জুড়ে দুই থেকে আড়াই হাজার মণ পাতা কেটেছে। কেউ কেউ গোলঝাড়ের ঠ্যাকপাতাসহ জ্বালানি কাঠও কেটেছে। চাঁদপাই রেঞ্জের ২নম্বর কুপের যেসব এলাকার বন উজাড় করে গোলপাতা কাটা হয়েছে তার মধ্যে বেড়ির খাল, নন্দবালা, সিংড়াবুনিয়া, তাম্বলবুনিয়ার আগা, শান্তির খাল, কলামুলা, চাঁনমিয়ার খাল, আলকির খাল অন্যতম।
জানতে চাইলে চাঁদপাই রেঞ্জ কর্মকর্তা (এসিএফ) মো. এনামুল হক বলেন, কিছু অনিয়মের কথা মৌখিকভাবে শুনেছি তবে লিখিতভাবে কেউ জানায়নি। লিখিত অভিযোগ পেলে তদন্ত করে দেখা হবে।
বাগেরহাট পূর্ব সুন্দরবন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) মুহাম্মদ বেলায়েত হোসেন বলেন, গোলপাতার কুপ চলমান থাকাকালে অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেওয়া যেত। মৌসুমের এক মাসের অধিক সময় পর এসব অভিযোগ এখন প্রমান করা কঠিন হয়ে পড়েছে।