দ্রুত গতিতে সামরিক শক্তি জোরদার করছে চীন। সম্প্রতি এই শক্তি আরও বাড়িয়েছে নতুন একটি রণতরি। এ ছাড়া দেশটির হাতে রয়েছে অত্যাধুনিক সব সমরাস্ত্র। সম্প্রতি যে রণতরিটি চীন সামনে এনেছে, তার নাম ‘ফুজিয়ান’।গত জুনে সাংহাইয়ে এর উদ্বোধন হয়। বলা হচ্ছে এটিই চীনের তৈরি করা সর্বাধুনিক প্রযুক্তির রণতরি। এসবের জেরে বিশ্বের সামরিক শক্তির ভারসাম্যে বড় ধরনের হেরফের হতে চলেছে বলে মনে করছেন পশ্চিমা পর্যবেক্ষকদের অনেকে।
২০৩৫ সালের মধ্যে চীনের সামরিক বাহিনীকে আধুনিকায়ন করার নির্দেশ দিয়েছেন দেশটির প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং। তার ভাষ্যমতে, চীনা সামরিক বাহিনীকে ২০৪৯ সালের মধ্যে ‘বিশ্বমানের’ হতে হবে, যাদের ‘যুদ্ধজয়ের’ সক্ষমতা থাকবে।
ফুজিয়ানসহ চীনের হাতে মোট তিনটি রণতরি রয়েছে। তবে বাকি দুটির চেয়ে ফুজিয়ানের তফাত হলো এটির নকশা করেছেন চীনা প্রকৌশলীরা। রণতরিটির দৈর্ঘ্য ৩১৫ মিটার, ওজন ৮৫ হাজার টন। আর হেলিকপ্টারসহ ৪০ থেকে ৬০টি সামরিক বিমান বহন করতে পারে সেটি।
সমরবিদেরা বলছেন, যুদ্ধবিমানগুলোকে আকাশে ওড়াতে ফুজিয়ানে ব্যবহার করা হয়েছে ইলেকট্রোম্যাগনেটিক ব্যবস্থা। এ প্রযুক্তি চীনা নৌবাহিনীকে অনেকটাই সামনের দিকে এগিয়ে নিয়েছে। এর ফলে যুদ্ধবিমানগুলো চটজলদি আকাশে ওড়ানো যাবে। আর প্রযুক্তি ব্যবহারের মধ্য দিয়ে রণতরিটিতে ভারী উড়োজাহাজ বহনের পথও খুলেছে।
তবে এটা এখনো স্পষ্ট নয় যে ফুজিয়ান মোতায়েনের জন্য পুরোপুরি প্রস্তুত করতে কত সময় লাগবে আর কবেই–বা সেটি নৌবাহিনীর বহরে যুক্ত হবে। ২০১৪ সালে আকারের দিক দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের নৌবাহিনীকে পেছনে ফেলেছিল চীনা নৌবাহিনী। আর ফুজিয়ান হাতে পেলে চীনা নৌবাহিনীর শক্তির পাল্লা আরও ভারী হবে।
বিশ্লেষকদের মতে, শুধু জাহাজের সংখ্যা বেশি থাকলেই একটি নৌবাহিনীকে সবচেয়ে শক্তিশালী বলা যাবে না। আকারে পিছিয়ে থাকলেও শক্তিমত্তার দিক দিয়ে চীনের চেয়ে এগিয়ে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের নৌবাহিনী। তাদের ১১টি রণতরি রয়েছে, যেখানে চীনের রয়েছে তিনটি। এ ছাড়া চীনের তুলনায় যুক্তরাষ্ট্রের পারমাণবিক অস্ত্র বহনে সক্ষম সাবমেরিন, ক্রুজার ও ডেস্ট্রয়ার ক্ষেপণাস্ত্রের সংখ্যা ঢের বেশি। বড় ধরনের যুদ্ধজাহাজের দিক দিয়েও এগিয়ে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র।
তবে চীন নৌবাহিনীর শক্তিমত্তা আরও অনেক বাড়াতে চায় বলেই ধারণা করা হয়। ২০২০ থেকে ২০৪০ সালের মধ্যে চীনের নৌবাহিনীর যুদ্ধজাহাজের সংখ্যা প্রায় ৪০ শতাংশ বাড়বে বলে অনুমান করছে যুক্তরাষ্ট্রের নৌবাহিনী।
চীনের নৌবাহিনীর আরও সম্প্রসারণ প্রয়োজন বলে মনে করেন দেশটির পিপলস লিবারেশন আর্মির সাবেক জ্যেষ্ঠ কর্নেল ঝউ বো। বেইজিংয়ের সিনহুয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ঝউ বো বলেন, সাগরে চীন যেসব হুমকির মুখে পড়ছে, সেগুলো সামাল দিতে দেশটির নৌবাহিনীর সম্প্রসারণ অতি জরুরি। তিনি বলেন, চীনের জলসীমায় যুক্তরাষ্ট্রের উসকানিকেই সবচেয়ে বড় সমস্যা হিসেবে দেখছেন তাঁরা।
পারমাণবিক অস্ত্রের মজুত বাড়াচ্ছে চীন
চীনের কাছে ২০২১ সালে ২৭২টি পারমাণবিক অস্ত্র ছিল। চলতি দশকের শেষ নাগাদ চীন এই অস্ত্রের সংখ্যা চার গুণ বাড়াতে চায় বলে গত নভেম্বরে একটি অনুমানের কথা জানিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়। তাদের ভাষ্যমতে, ২০৩০ সালের আগেই চীন অন্তত ১ হাজার পারমাণবিক বোমা হাতে রাখার পরিকল্পনা করছে।
যুক্তরাষ্ট্রের কাছে এ মুহূর্তে ৫ হাজার ৫৫০টি পারমাণবিক বোমা রয়েছে। তাই সংখ্যার হিসাবে যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে অনেকপিছিয়ে আছে চীন। তারপরও দেশটির পারমাণবিক অস্ত্রগুলোকে পশ্চিমা সামরিক বাহিনীর আধিপত্যের জন্য বড় হুমকি হিসেবে দেখা হচ্ছে।
হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র
হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্রগুলো শব্দের পাঁচ গুণের চেয়ে বেশি গতিতে ছুটতে পারে। তবে আন্তমহাদেশীয় ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রের (আইসিবিএম) চেয়ে এর গতি কম। এরপরও হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র রাডারে শনাক্ত করা খুবই কঠিন। এ কারণে এগুলো অনেক আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থাকে সহজেই ফাঁকি দিতে পারে।
চীন অবশ্য হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্রের পরীক্ষা চালানোর বিষয়টি অস্বীকার করেছে। তবে পশ্চিমা বিশ্লেষকদের ধারণা, গত গ্রীষ্মে চীন থেকে দুটি রকেট ছোড়ার ঘটনা এটাই ইঙ্গিত দিচ্ছে যে দেশটির সামরিক বাহিনী হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র হাতে পাওয়ার পথে রয়েছে।
চীন কী ধরনের হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র নিয়ে কাজ করছে, তা এখন পর্যন্ত পরিষ্কার নয়। এ ক্ষেপণাস্ত্রের মূলত দুটি ধরন রয়েছে। একটি হাইপারসনিক গ্লাইড ক্ষেপণাস্ত্র। এসব ক্ষেপণাস্ত্র পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের ভেতর দিয়েই উড়ে যায়।
অপরটি ফ্রাকশনাল অরবিটাল বোম্বার্ডমেন্ট সিস্টেম (এফওবিএস)। এটি বায়ুমণ্ডলের বাইরে পৃথিবীর কক্ষপথের নিচের দিক দিয়ে লক্ষ্যবস্তুর দিকে এগিয়ে যায়। চীন এই দুটি ধরনের সমন্বয়ে হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র উন্নয়নে সফল হয়েছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা
যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের দেওয়া তথ্য বলছে, চীন এখন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মতো প্রযুক্তি ব্যবহার করে ‘বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন’ সমরাস্ত্র তৈরির দিকে পুরোপুরি নজর দিচ্ছে। চীনের একাডেমি অব মিলিটারি সায়েন্সও এই প্রক্রিয়ায় এগোতে সায় দিয়েছে।
চীন যে এরই মধ্যে মিলিটারি রোবোটিকস ও মিসাইল গাইডেন্স সিস্টেমে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার করছে—এমন ইঙ্গিত নানা প্রতিবেদনে পাওয়া গেছে। চালকবিহীন উড়োজাহাজ ও নৌযানেও এ প্রযুক্তির ব্যবহার হচ্ছে বলে মনে করা হয়।