প্রথমবারের মতো ফুটবল বিশ্বকাপের মহাযজ্ঞ বসছে মরুভূমির দেশ কাতারে। মধ্যপ্রাচ্যের দেশ কাতারের মাটিতে ‘দ্য গ্রেটেস্ট শো অন আর্থ’র মহারণ শুরু হতে যাচ্ছে আগামীকাল। চলুন কাতার বিশ্বকাপের আগে ফিরে তাকানো যাক ২০১৪ বিশ্বকাপের গল্পে। ২০১৪ বিশ্বকাপে সবচেয়ে বেশিবার বিশ্বকাপজয়ী ব্রাজিল গুনে গুনে সাতটা গোল খায় জার্মানির বিপক্ষে।
নিজেদের দর্শকদের সামনে এক লজ্জার অধ্যায় জন্ম দিয়ে বিদায় নেয় সেমিফাইনাল থেকে।
জার্মানির কাছে ৭-১ গোলে হারা ব্রাজিলের ম্যাচ ফুটবল লোকগাথার অংশ এখন। ফুটবলের সবচেয়ে সফল দল ব্রাজিল, কিন্তু ব্রাজিলিয়ানরাও জানেন এই ইতিহাস আর পালটানো যাবে না। যতবার বিশ্বকাপ দরজায় কড়া নাড়বে ততোবার ঘুরে ফিরে আসবে ওই গল্প। মারাকানাজোর ‘কুখ্যাত’ ইতিহাস ভুলতে পারেনি ব্রাজিল। ৫ বিশ্বকাপ জেতার পরও না। একটা প্রজন্ম বদলে গেছে ব্রাজিলে, ইতিহাস মাটিচাপা দেওয়ার আগেই নতুন আরেক ট্রাজেডির ‘নায়ক’ হতে হয়েছে ব্রাজিলকে।
সেদিন জার্মানি প্রথম গোল করলো কর্নার থেকে, ১১ মিনিটে। ওই কর্নার নেওয়ার সময় কাছের পোস্টে ছিলেন ৩ জন জার্মান ফুটবলার, তাদের পাহারা দিতে ছিলেন আরও ৬ জন ব্রাজিলিয়ান। থমাস মুলারকে গোলের সামনে থেকে হেডও করতে হয়নি। সাইড ভলিতে গোল করেছিলেন তিনি। বোল্ড করে লিখতে হয়, সাইড ভলিতে।
মুলারকে কেউ বাধাও দেননি। বল যখন উড়ে আসছিল, বিপদটা টের পেয়েছিলেন লুইজ। জটলার ভেতর থেকে পেছন ফিরে উদভ্রান্তের মতো দৌড়ও শুরু করেছিলেন। মানুষ ভুল করে, মেশিন তো আর করে না। মুলার তো রমডয়টার, তিনিও ভুল করেননি।
জার্মানি ওই ম্যাচের আগে খুব একটা ছন্দে ছিল না। আলজেরিয়ার সঙ্গে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে দ্বিতীয় পর্ব পার করার পর কোয়ার্টার ফাইনালেও ফ্রান্সের বিপক্ষে ম্যাড়মেড়ে এক জয়। জার্মানি সেমিফাইনালে উঠেছিল নিজেদের সেরাটা না দেখিয়েই। মুলারের প্রথম গোলের পরের গল্প সবার জানা। ৬ মিনিটের ব্যবধানে ব্রাজিলের ৪ গোল খাওয়ার গল্প। প্রায় সবগুলো গোলের উৎসই ব্রাজিলের বাম প্রান্ত। ব্রাজিল গোল হজম করছে, দ্বিগুণ উৎসাহে নাকি প্রবল আক্রোশে মার্সেলো আক্রমণেই উঠেছেন। একবার ওজিলকে ওভারল্যাপ করে যাচ্ছেন লাম, আরেকবার আন্ডারল্যাপ করে যাচ্ছেন। ওই প্রান্তে তখন খুনের নেশায় পেয়েছে জার্মানিকে।
২৩ মিনিটে মিরোস্লাভ ক্লোজা ভাঙলেন রোনালদোর রেকর্ড। ব্রাজিলের মাঠে ব্রাজিলের সেরা সন্তানের রেকর্ড হাতছাড়া। ঘরের মাঠে সেমিফাইনাল শুরু না হতেই দুই গোল খেয়ে বসা। এর চেয়ে মর্মান্তিক আর কী হয়? হয়। কী হতে পারে সেটা টের পেয়েছিল সেদিন ব্রাজিল।
টনি ক্রুস, স্যামি খেদিরারাও স্কোরশিটে নাম লেখালেন। অন্যদলকে নিয়ে ছেলেখেলা করার বাংলা বিশেষণটা আরও অর্থবহ হলো সেদিন। ব্যাপারটা এমন ব্রাজিলের বক্সের ভেতর যেই যায় সেই গোল করে আসে। ফার্নান্দিনহো একরকম খেলাই ছেড়ে দিয়েছেন। ২৯ মিনিটের পঞ্চম গোলের সময় মাঝমাঠেও খুঁজে পাওয়া গেল না লুইজকে। ওয়াইড অ্যাঙ্গেল ক্যামেরাতেও হারিয়ে গেছেন তিনি।
দ্বিতীয়ার্ধে জার্মানি আর গোল করতে চায়নি। কী ঘটছে ততক্ষণে সেটা টের পেয়ে গিয়েছিলেন ক্রুস, মুলাররা। একটা দেশে বিশ্বকাপ খেলতে এসেছেন, আতিথ্য দিয়েছে তারা। জার্মানদের বরণ করেছে সানন্দেই। ম্যাচের আগেও স্কলারি উপহারের প্যাকেট তুলে দিয়েছিলেন ইউগি লভের হাতে। খেলায় লজ্জার কিছু নেই, কিন্তু ওই স্কোরলাইন সেই বেদবাক্যও বদলে দিচ্ছিল। বিশ্বকাপের ইতিহাসেই সেমিফাইনালে এতোগুলো গোল হয়নি কখনও। প্রায় ১০০ বছরের বিশ্বকাপের ইতিহাসে কখনও ৩ গোলের বেশিও হজম করেনি ব্রাজিল। আন্দ্রে শারলে অবশ্য ওসব মাথা নিয়ে মাথা ঘামাননি। বদলি হয়ে মাঠে নেমে হয়ত ফাইনালে একটা সুযোগ পাওয়ার আশা করেছিলেন। তিনিই যোগ করেছিলেন আরও দুই গোল। জার্মানি চাইলেই আরও ৪/৫ বার বল জড়াতে পারত সিজারের জালে।
সিজারের অবশ্য এসব নিয়ে আর অনুযোগ নেই। জীবনে কতোকিছুই মেনে নিতে হয়, সিজারও সেভাবেই মানিয়ে নিয়েছেন। ওই বিশ্বকাপের পর ব্রাজিলের ২৩ জনের স্কোয়াডের ১০ জন আর কখনই ব্রাজিলের জার্সি গায়ে চড়াতে পারেননি। তাদের মধ্যে একজন তিনিও।