আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) থেকে ৪৫০ কোটি মার্কিন ডলার (আনুমানিক ৪৫ হাজার কোটি টাকা) ঋণ পেতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল গতকাল বুধবার এক সংবাদ সম্মেলনে এ কথা জানান।
অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘নতুন কোনো শর্ত ছাড়াই আমরা আইএমএফ থেকে ৪ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার ঋণ পাচ্ছি। আমরা যেভাবে চেয়েছিলাম সেভাবেই ঋণ পাচ্ছি
তিনি জানান, সাত কিস্তিতে ২০২৬ সাল পর্যন্ত ঋণ পাবে বাংলাদেশ। প্রথম কিস্তি আসবে আগামী বছরের ফেব্রুয়ারিতে।
তবে এ ঋণ পেতে হলে সরকারকে কিছু শর্ত মানতে হবে। যদিও সরকার শর্তগুলো বলতে নারাজ। এদিকে সরকার-আইএমএফ কোনো পক্ষই শর্ত বলছে না। এটিকে আর্থিক খাতের সংস্কার কার্যক্রম হিসেবে আখ্যা দিয়েছে উভয় পক্ষ।
ঋণ পেতে যা করতে হবে
আইএমএফ বলেছে, এ ঋণ পেতে বাংলাদেশকে আর্থিক খাতে বেশকিছু সংস্কারমূলক কাজ করতে হবে। এর মধ্যে ভ্যাট আইন, ২০১২-এর পূর্ণ বাস্তবায়ন, রাজস্ব আয় বৃদ্ধি, আর্থিক খাতের নজরদারি বৃদ্ধি, বাংলাদেশ ব্যাংকের স্বাধীনতা, জ্বালানি খাতের ভর্তুকি কমানো, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ, জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতি কাটাতে প্রতিষ্ঠানগুলোকে শক্তিশালী করে তোলা, ব্যাংক ঋণ ও আমানতের সুদহার বাড়ানো, আন্তর্জাতিক মানদন্ড অনুযায়ী রিজার্ভের হিসাব, নতুন বৈদেশিক বিনিয়োগের পরিবেশ উন্নয়নসহ আরও কিছু সংস্কারমূলক কার্যক্রম পরিপালন করতে হবে বাংলাদেশকে। তবে বাংলাদেশ কখনই ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হয়নি। আইএমএফের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক দীর্ঘদিনের। এমনকি বাংলাদেশের অবস্থা কখনই শ্রীলঙ্কার মতো হবে না।
এ প্রসঙ্গে প্রতিনিধি দলের প্রধান রাহুল আনন্দ বলেন, আইএমএফ মার্চে সারা বিশ্বের ডেবথ সাইটেইনেবিলিটি নিয়ে একটি বিশ্লেষণ প্রতিবেদন করেছে। সেখানে দেখা গেছে বাংলাদেশ ডেবথ সাসটেইনেবল। সেখানে বাংলাদেশের ঋণ ৪০ শতাংশের কম। এর মধ্যে (এক্সটারনাল) বৈদেশিক ঋণ দেখা গেছে ২০ শতাংশ, যা খুবই সহনশীল। তবে সাড়ে তিন মাসের আমদানি ব্যয়ের মতো রিজার্ভ থাকাটা ঝুঁকিপূর্ণ। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের প্রকৃত রিজার্ভ ২৬ বিলিয়ন ডলার। যদিও সরকার তা ৩৬ বিলিয়ন ডলার হিসেবে দেখাচ্ছে।
এ ঋণের প্রথম কিস্তি ৪৪৭ মিলিয়ন ডলার পাওয়া যাবে আসছে ফেব্রুয়ারিতে। বাকি অর্থ ৬৫৯ মিলিয়ন ডলার সমান ছয় কিস্তিতে ২০২৬ সালের মধ্যে পাবে বাংলাদেশ। সরকার-আইএমএফ কোনো পক্ষই শর্ত বলছে না। এটিকে আর্থিক খাতের সংস্কার কার্যক্রম হিসেবে আখ্যা দিয়েছে উভয় পক্ষ।
এ প্রসঙ্গে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, ‘এখানে মূল বিষয় হলো, কোনো শর্তই পরিষ্কার নয়। উভয় পক্ষ যেসব সংস্কারের কথা বলেছে সেগুলো তো আসলেই চলমান। কিন্তু এর বাইরে কোনো শর্ত আছে কি না- যেমন প্রথম কিস্তি পাওয়ার আগে কী কী করতে হবে। পরবর্র্তী কিস্তিগুলো পাওয়ার আগে কোন সময় কী করতে হবে সেগুলো তো নির্দিষ্ট করে প্রকাশ করা হয়নি। ফলে এখানে কিছুটা অস্পষ্টতা রয়েছে। আর চলমান সংকট মোকাবিলায় এ ঋণ কতটা কার্যকর হবে বা সংকট কেটে যাবে কি না তা এখনই বলা যাবে না। তবে কিছুটা ইতিবাচক প্রভাব তো অর্থনীতিতে পড়বেই। ’
এ ঋণের ফলস্বরূপ সরকারের কিছুটা লাভ হবে। ব্যবসায়ীদের লাভ হবে। আইএমএফের ব্যবসা হবে। কিন্তু জনগণের কোনো লাভ হবে না। কারণ জিনিসপত্রের দামও কমবে না। আরও ভোগান্তি বাড়বে। ফলে এ ঋণের কারণে জনগণের কোনো কল্যাণ হবে না বলে মনে করেন বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. আনু মুহাম্মদ।
নিজ দফতরে আইএমএফ প্রতিনিধি দলের সঙ্গে বিদায়ী বৈঠকের পর সংবাদ সম্মেলনে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেন, ‘আমরা আইএমএফ থেকে যেভাবে ঋণ সহযোগিতা চেয়েছিলাম, সেভাবেই আইএমএফ বাংলাদেশকে মোট সাত কিস্তিতে ৪৫০ কোটি ডলার ঋণ দিতে যাচ্ছে, যার প্রথম কিস্তি ৪৪৭ দশমিক ৪৮ মিলিয়ন ডলার ছাড়ের প্রক্রিয়া শুরু হবে ফেব্রুয়ারিতে। এরপর পরবর্তী ছয় কিস্তি সমানভাবে মোট ৬৫৯ দশমিক ১৮ মিলিয়ন ডলার করে ছাড় করবে। আগামী বছরের ফেব্রুয়ারি থেকে ২০২৬ সালের মধ্যে চার বছর মেয়াদি এ ঋণ ছাড়ের প্রক্রিয়া সম্পন্ন হবে। এ ঋণের গ্রেস পিরিয়ড রাখা হয়েছে ন্যূনতম সাড়ে তিন বছর থেকে ১০ বছর। আর পরিশোধের সর্বোচ্চ সুযোগ রয়েছে ২০ বছর। ‘
তিনি বলেন, ‘সারা বিশ্বের অর্থনীতিই এখন একটি ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। উন্নত থেকে উন্নয়নশীল সব দেশে অস্বাভাবিক মূল্য বৃদ্ধি ঘটেছে। প্রায় সব দেশের মুদ্রার মান ডলারের বিপরীতে কমে গিয়েছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমেছে। বৈশ্বিক অর্থনীতির উত্তাপের আঁচ আমাদের অর্থনীতিতেও কিছুটা লেগেছে। এ অস্থিরতায় যাতে কোনো ধরনের সংকট ঘনীভূত না হয় তা নিশ্চিত করতেই আমরা আগাম সতর্কতা হিসেবে আইএমএফের ঋণের জন্য অনুরোধ করেছিলাম। ‘
অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘আইএমএফের সঙ্গে এর আগে একাধিকবার বৈঠক হয়েছে। চলমান ঋণ আলোচনার পর্বটি আজ (বুধবার) আমরা সফলভাবে সমাপ্ত করলাম। আমরা যেভাবে ঋণ চেয়েছিলাম, ঠিক সেভাবেই ঋণ পেতে যাচ্ছি বলে আমি আশা করছি। ‘