নূরজাহান বোস। প্রমত্তা আগুনমুখা নদীর তীরের সংগ্রামী এক নারী। যার বেড়ে ওঠা আগুনমুখার কোলঘেঁষে জেগে ওঠা অবহেলিত একটি এলাকায়।
প্রতিকূল পরিবেশে জন্ম, পিছিয়ে পড়া তখনকার সমাজব্যবস্থায় কিছুতেই হার মানেনি তিনি। নানা প্রতিকূলতা, অসমতা, অন্যায্যতার সঙ্গে প্রতিনিয়ত সংগ্রাম করে বেড়ে উঠেন নূরজাহান বোস। সেই নূরজাহান বোস এখন নারী অগ্রযাত্রায় অনন্য। চরাঞ্চলের নারীদের শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার পাশাপাশি কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরিতে ভূমিকা রাখছেন তিনি।
নূরজাহান বোসের জন্ম পটুয়াখালীর রাঙ্গাবালী উপজেলার বড়বাইশদিয়া ইউনিয়নের কাটাখালী গ্রামে। আগুনমুখা নদীর পাড়ের ওই গ্রামে বেড়ে ওঠার লড়াকু জীবনের অভিজ্ঞতা নিয়ে লিখেছেন আলোড়ন সৃষ্টিকারী অনবদ্য জীবনকথা ‘আগুনমুখার মেয়ে’। ২০১৬ সালে এই আত্মজীবনী লিখে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার লাভ করেন তিনি।
জানা গেছে, ২০০০ সালে নারীর ক্ষমতায়নের জন্য ‘সংহতি’ নামক জনকল্যানমূলক একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন নূরজাহান বোস ও তার মেয়ে মণিকা জাহান বোস।
স্থানীয়রা জানান, নিজ গ্রাম কাটাখালীতে অসহায় বঞ্চিত নিপীড়িত নির্যাতিত নারীদের কল্যাণের জন্য প্রতিনিয়ত কাজ করে যাচ্ছে সংগঠনটি।
জানা গেছে, এই অঞ্চলের অবহেলিত বেকার নারীদের কর্মদক্ষতা বাড়িয়ে কর্মসংস্থানেরও সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখছেন তিনি। এমনকি বিনাসুদে ঋণ প্রদানের মাধ্যমে স্বাবলম্বী করে তুলেছেন অনেককে। ‘সংহতি’ ছাড়াও নির্যাতিত নারীদের মানসিক ও আইনগত সহায়তা দেওয়ার জন্য সাপোর্ট গ্রুপ হিসেবে ‘আশা’ নামেরও একটি সংগঠন গড়ে তুলেছেন নূরজাহান বোস। শুধু নিজ গ্রামেই নয়, রংপুরের গঙ্গাচড়া থানার দুটি গ্রামে একই ধরনের কর্মসূচির আওতায় এনেছেন নূরজাহান বোস।
জানা গেছে, আধুনিক চিকিৎসা বঞ্চিত মানুষের জন্য নিজ গ্রাম কাটাখালীতে ২০০৭ সালের ১২ মার্চ তার মায়ের নামে ‘জোহরা বেগম স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র’ নামক একটি প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম শুরু করেন। নূরজাহান বোসের স্বাস্থ্য সেবাকেন্দ্র ও মহিলা সমিতির পরিচালক মাতোয়ারা বেগম বলেন, ‘প্রথমে আমরা এখানকার ৫০ জন বেকার এবং দরিদ্র নারীদের নিয়ে একটি নারী সংগঠন তৈরি করেছি। তাদের ব্লক বাটিক, মোমবাতি তৈরির কাজ শেখাই। এর পর ধীরে ধীরে আমাদের সংগঠনকে দুটি সমিতিতে ভাগ করি। একটির নাম কাটাখালী মোহনা মহিলা সমিতি আরেকটির নাম মধুখালী চাঁদনী মহিলা সমিতি। এখন দুই সমিতিতে সদস্য সংখ্যা ৭২ জন হয়েছে। তাদের স্বাবলম্বী করতে জনপ্রতি সর্বোচ্চ ১০ হাজার টাকার ঋণ প্রদান করা হয়। কিন্তু সদস্যদের এ টাকার কোনো লভ্যাংশ দিতে হয় না। ২০০০ সালের দিকে আমাদের এ কার্যক্রম শুরু হয়।
আন্তর্জাতিক নারী দিবসে আজ নূরজাহান বোসের সঙ্গে কথা হয় যুগান্তরের। মোবাইল ফোনের সাক্ষাৎকারে নুরজাহান বোস বলেন, প্রতিদিনই নারী দিবস হোক এটিই আমি চাই। নারীরা আমার ছোটবেলার চেয়ে এখন অনেক এগিয়েছে। এগিয়ে যেতে হবে। সব নারী ও শিশুর ওপর এখনও চলছে নারী নির্যাতন, যৌন নির্যাতন— আমিও এর শিকার। আমি চাচ্ছি যে, এর অবসান না হওয়া পর্যন্ত আমাদের আন্দোলন চালিয়ে যেতে হবে। তিনি বলেন, যদিও এ দেশের নারী আন্দোলন শুরু হয়েছে; কিন্তু এখনও কোনো নারী সুবিচার পাননি। সুতরাং প্রতি বছরই নারী দিবসের নামে একটি সভা-সেমিনার হয়, যা ওই দিন পর্যন্ত শেষ হয়ে যায়। নারীদের কোনো রকমের অধিকারই এখন পর্যন্ত আসেনি। একটা বাচ্চা মেয়েকে যখন তার বাবা ধর্ষণ করে। আমি তাকে গ্রেফতার করিয়ে ছিলাম; আমার এলাকায়। তার পর সরকারি বিচারে তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। সেই মেয়েটাকেও তার বাবার কাছে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে তিনি আরও বলেন, এখনও প্রতিটি ঘরে ঘরে নারী ও শিশু নির্যাতিত হয়। আর এগুলো যতদিন বন্ধ না হয়, বাল্যবিবাহ বন্ধ না হয়, নারীদের প্রতি সহিংসতা বন্ধ না হয়, ততদিন পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাব। আমি আশা করি প্রত্যেক নারী-শিশু এ আন্দোলন চালিয়ে যাবে। সারাজীবন চালিয়ে যাবে। নূরজাহান বোসের নারী ক্ষমতায়নের উদ্যোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমার মা অর্থাৎ জোহরা বেগম বলেছিলেন— তোমরা এখন নিজেরা প্রতিষ্ঠিত হয়েছ, এখানকার অবহেলিত মানুষের জন্য কিছু করো। সেখান থেকেই এই উদ্যোগ গ্রহণ করা। তিনি আরও বলেন, আমাদের এখানে দুটি বয়স্ক শিক্ষাকেন্দ্র রয়েছে। এর পাশাপাশি রয়েছে একটি খেলাঘর। তা ছাড়া আমাদের সংগঠনের নারীদের যে কোনো সমস্যা আমরা নিজেরাই সমাধানের চেষ্টা করি।
এ ব্যাপারে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মাশফাকুর রহমান বলেন, নূরজাহান বোস একজন সফল নারী। নারীদের অধিকার নিয়ে তার নিজ গ্রামে তিনি কাজ করে যাচ্ছেন। একটি স্বাস্থ্যকেন্দ্রেও করেছেন। তার এসব উদ্যোগ প্রশংসনীয়।
কে এই নূরজাহান বোস? ১৯৩৮ সালের ১৪ মার্চ উপজেলা রাঙ্গাবালীর বড়বাইশদিয়া ইউনিয়নের কাটাখালী গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্ম নেন নূরজাহান। বাবা আবদুর রাজ্জাক, মা জোহরা বেগম।
গ্রামের স্কুলে চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত লেখা পড়া করেন। পরে পরিবার সদস্যদের উৎসাহে জেলা শহরে যান। ১৯৫৪ সালে পটুয়াখালী বালিকা উচ্চবিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাশ করেন তিনি। ১৬ বছর বয়সে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক এমাদুল্লাহর সঙ্গে ১৯৫৫ সালে তার বিয়ে হয়। এক বছরের মাথায় অর্থাৎ ১৯৫৬ সালে চিকেন পক্স (বসন্ত রোগে) আক্রান্ত হয়ে এমাদুল্লাহর মৃত্যু হয়। তখন নূরজাহান সন্তানসম্ভবা। প্রথম সন্তান জসিমের জন্মের পর তিনি একটি স্কুলে হোস্টেল সুপারের দায়িত্বগ্রহণ করেন।
১৯৬২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও ইতিহাস নিয়ে বিএ পাশ করে এমএ ভর্তি হন। তার মৃত স্বামীর ঘনিষ্ঠ বন্ধু স্বদেশ বসুরমাধ্যমে তিনি রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে জীবন শুরু করেন। পরবর্তী সময় স্বদেশের সঙ্গে ১৯৬৩ সালে তার বিয়ে হয়। এর পর স্বদেশ কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি করার সুযোগ লাভ করেন।