তিন বছরের শিশু নিতিশা। আগের মতো খেলতে পারে না সে। ওজনও অনেক কমে গেছে। পায়ে ব্যথা ও দুর্বলতার কথা চিকিৎসককে জানিয়েছে নিতিশা।
চিকিৎসক বলছেন, নিতিশা ঠিক মতো খাবার পাচ্ছে না, তাই তো অপুষ্টিতে ভুগছে। এই শিশুকে স্বাস্থ্যকর খাবার দিতে তার পরিবারকে পরামর্শ দিয়েছে চিকিৎসক। তবে পরামর্শ মেনে চলতে পারছে না তারা।
শ্রীলঙ্কার কেন্দ্রস্থল হানাথার একটি চা বাগানের পাশের গ্রামে থাকে নিতিশার পরিবার। অন্যান্যদের মতো এই পরিবারটিও তাদের আর্থিক অবস্থার পতন দেখেছে।
নিতিশার মা হারশিনি বলেন, ‘বর্তমানে দিনে দুবেলা খাবারের ব্যবস্থা করতে পারছি আমরা। প্রতি বেলায় আমরা ভাতের সঙ্গে আলু বা মসুরের ডাল খাচ্ছি। এর বাইরে আমরা কোনো কিছুই খেতে পারছি না। ’
‘কয়েক সপ্তাহ ধরে আমরা দুধ কিংবা ডিম খায়নি,’ যোগ করেন এই মা।
হারশিনির সবচেয়ে ছোট সন্তান (মেয়ে) মাত্র এক মাস বয়সী। কম ওজনেই পৃথিবীতে এসেছে এই নবজাতক। জন্ম থেকেই এই নবজাতকের থাইরক্সিনের (শিশুর বেড়ে উঠার জন্য যে হরমোন সাহায্য করে) অভাব রয়েছে। পুষ্টিহীনতায় থাকা মায়েদের কম ওজনের শিশুর জন্মের মধ্যে যোগ হয়েছে এই নবজাতক।
শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক দুরবস্থার কথা কারও অজানা নয়। ঋণ পরিশোধ করতে না পেরে দেউলিয়া হয়েছে দক্ষিণ এশিয়ার দেশটি। রিজার্ভ প্রায় শূন্যের কোটায়। অবস্থা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে প্রয়োজনীয় নিত্য পণ্য আমদানি করতে পারছে দেশটি।
দক্ষিণ এশিয়ার দেশটির অর্থনৈতিক সংকটের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে খাদ্য। দেশটির নাগরিকদের আয় কমেছে ও খাবারের দাম বাড়ছে। খাদ্য জোগাড়ে হিমশিম খেতে হচ্ছে পরিবারগুলোকে। এর ফলে খুদা পেটে থাকতে বাধ্য হচ্ছে তারা।
খাদ্যের সংকটে নিতিশার গ্রামের অনেক শিশু অসুস্থ হয়ে পড়েছে। সেখানকার চিকিৎসকরা বলছেন, তারা যেসব শিশু রোগী দেখছেন এর অধিকাংশই ঠিক মতো খেতে পারছে না।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক চিকিৎসক বলেন, ‘অপুষ্টির প্রভাব সামনে আসতে সময় লাগে। বর্তমানে বেশির ভাগ কম খেতে পারা শিশুরা তাদের শরীরে সঞ্চিত প্রোটিন ব্যবহার করছে। কিন্তু একটানা পুষ্টির অপ্রতুলতা দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ফেলবে। ’
জাতিসংঘের সংস্থা ইউনিসেফের তথ্য মতে, শ্রীলঙ্কার অন্তত ৫৬ হাজার শিশু পুষ্টিহীনতায় ভুগছে।
বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির (ডব্লিউএফপি) সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুসারে, শ্রীলঙ্কার প্রায় এক তৃতীয়াংশ পরিবারের খাদ্যের নিরাপদ উৎস নেই। প্রায় ৭০ শতাংশ পরিবার খাবারের পরিমাণ কমিয়ে দিচ্ছে।
পুষ্টিহীনতা ও মা
হানাথায় বাস করেন ২৪ বছর বয়সী কাঞ্চানা। চার মাসের অন্তঃসত্ত্বা এই নারীর যমজ সন্তান হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। কাঞ্চানা বলেন, ‘আমার প্রচুর খিদে লাগে, তাই আমি ভাত খাই। মাছ, ডিম ও ফলফলাদির দাম অনেক। আমরা চিকিৎসার জন্য ব্যয় করবো নাকি খাদ্যের জন্য খরচ করবো এ নিয়ে দোটানায় থাকতে হয়। ’
হানাথার কয়েক কিলোমিটার দূরে আরেকটি গ্রামে দেখা মিলে আরেক গর্ভবতীর। দেবি নামক ওই নারীর দ্বিতীয়বারের মতো অন্তঃসত্ত্বা। তবে গর্ভে থাকা ওই শিশু ওজন তুলনামূলকভাবে অনেক কম। এমনকি রক্তশূন্যতায় ভুগছে দেবি। এই নারীর স্বাস্থ্য পরিবর্তনের বিকল্পগুলো সীমিত।
দেবি বলেন, ‘আমি চেয়েছিলাম আমার দ্বিতীয় সন্তান স্বাস্থ্যকর হোক, কিন্তু তার অবস্থা খারাপ। চিকিৎসক বলেছেন, যদি আমি ভাল না খাই তবে আমার সন্তানের ঠিক মতো বিকাশ হবে না। ’
শ্রীলঙ্কায় মায়েদের পুষ্টিহীনতা থেকে রক্ষার্থে একটি প্যাকেজ রয়েছে। পুষ্টি সমৃদ্ধ একটি করে প্যাকেট প্রতিটি গর্ভবতী নারীকে দৈনন্দিন দেওয়া হতো। তবে অর্থাভাবে গত বছর এই প্যাকেজটি বন্ধ ঘোষণা করা হয়। গত মাসে সেটি আবার চালু করা হলেও খুব কম সংখ্যক গর্ভবতী এর আওতায় রয়েছে।
দেবি বলেন, ‘আমার মতো অনেক নারী প্যাকেজটির আওতায় আসার জন্য আবেদন করেছে। তবে ইতোমধ্যে অর্ধেক গর্ভবতীর সন্তান প্রসব হয়ে গেছে। এখন পর্যন্ত আমি একটি প্যাকেট খাবারও পাইনি। ’
শ্রীলঙ্কায় ইউনিসেফের কান্ট্রি রিপ্রেজেন্টেটিভ ক্রিশ্চিয়ান স্কুগ বলেন, ‘মায়েরা আগের মতো পুষ্টিকর খাবার খেতে পারছেন না। এই সংকটটি ইতোমধ্যে প্রকট হচ্ছে। শ্রীলঙ্কায় কম ওজনের জন্ম নেওয়া শিশু একটি বড় সমস্যা। ’
স্কুল পড়ুয়া শিশুরা ক্ষুধার্ত
দক্ষিণ শ্রীলঙ্কার মাথুগামার হোরাওয়ালা স্কুলের ভাইস প্রিন্সিপাল হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন অনোমা শ্রীয়াঙ্গি ধর্মবর্ধনে। তিনি বলেন, ‘প্রাথমিকে পড়ুয়া বেশিরভাগ শিশু না খেয়ে স্কুলে আসছে। প্রতিদিন ২০-২৫ জন শিশু স্কুল চলাকালীন সময়ে অজ্ঞান হয়ে পড়ছে। ’
স্কুলের শিশুদের খাবার দিতে একটি প্রোগ্রাম চালু করেছে স্কুলটি। তবে এটি নির্ভর করছে ফান্ডের ওপর।
মানবাধিকার সংস্থা এফআইএএনের প্রেসিডেন্ট এস ভিসভালিনগাম বলেন, ‘কমপক্ষে ২০ শতাংশ শিশু সকালের নাস্তা পাচ্ছে না। তারা খালি পেটেই স্কুলে যাচ্ছে। ’
গত ছয় মাস ধরে এফআইএএন প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিশুদের জন্য খাদ্য কর্মসূচির আয়োজন করেছে।
এস ভিসভালিনগাম বলেন, ‘শিক্ষার্থীরা স্কুল ছেড়ে দিচ্ছে। বিশেষ করে উত্তর ও পূর্ব শ্রীলঙ্কার চা বাগান এলাকার শিশুদের মধ্যে এই প্রবণতা সবচেয়ে বেশি। শিশুদের স্কুলে ফিরিয়ে আনতেই খাবারের প্রোগ্রাম করা হচ্ছে। ’
শ্রীলঙ্কার সরকারি কর্মকর্তারা অপুষ্টির ক্রমবর্ধমান সংকটের কথা স্বীকার করেছেন। দেশটির স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের পারিবারিক স্বাস্থ্য ব্যুরোর সাম্প্রতিক তথ্যে দেখা গেছে, গত এক বছরে শিশুদের মধ্যে বয়স অনুযায়ী ওজন ও উচ্চতা উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেয়েছে।