হেফাজতে ইসলামের সাবেক আমির আল্লামা শাহ আহমদ শফীকে ‘মানসিক নির্যাতন করে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে’—এমন অভিযোগ এনে আদালতে মামলা করেছে তাঁর পরিবার। মামলায় হেফাজতের যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা নাছির উদ্দিন মুনির ও মাওলানা মুহাম্মদ মামুনুল হকসহ ৩৬ জনকে আসামি করা হয়েছে। আদালত মামলাটি আমলে নিয়ে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনকে (পিবিআই) তদন্ত করে এক মাসের মধ্যে প্রতিবেদন দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন।
গতকাল বৃহস্পতিবার সকালে চট্টগ্রামের জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট শিপলু কুমার দের আদালতে মামলাটি করেছেন প্রয়াত আল্লামা শফীর শ্যালক মোহাম্মদ মঈনউদ্দিন। তিনি হেফাজতের বর্তমান কমিটির কোনো পদে নেই।
মামলায় উল্লেখ করা আসামিদের বেশির ভাগই হেফাজতের বর্তমান আমির জুনাইদ বাবুনগরীর অনুসারী; তাঁরা বিভিন্ন পদে রয়েছেন। এ ছাড়া অজ্ঞাতপরিচয় হিসেবে আরো ৮০-৯০ জনকে আসামি করা হয়েছে বলে আদালত সূত্র জানিয়েছে।
মামলার বাদীর আইনজীবী অ্যাডভোকেট মো. আবু হানিফ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আল্লামা শাহ আহমদ শফীর স্বাভাবিক মৃত্যু হয়নি। তাঁকে পূর্বপরিকল্পিতভাবে মানসিক নির্যাতন করে হত্যার অভিযোগ এনে উনার শ্যালক বাদী হয়ে মামলাটি করেছেন। মামলায় ঘটনার চারটি তারিখ (চলতি বছরের ১১, ১৬, ১৭ ও ১৮ সেপ্টেম্বর) উল্লেখ করা হয়েছে। ঘটনা তদন্ত করে দোষী ব্যক্তিদের বিচারের আওতায় আনার দাবি জানানো হয়েছে। আদালত পিবিআইকে তদন্তের দায়িত্ব দিয়েছেন। আমরা আদালতের কাছে সুবিচার কামনা করেছি।
মামলায় ১ নম্বর আসামি করা হয়েছে হেফাজতের যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা নাছির উদ্দিন মুনিরকে, ২ নম্বর আসামি মাওলানা মুহাম্মদ মামুনুল হক। এ ছাড়া অন্য আসামিরা হলেন হেফাজতের সাংগঠনিক সম্পাদক আজিজুল হক ইসলামাবাদী, সহকারী সাংগঠনিক সম্পাদক মাওলানা মীর ইদরিস, প্রচার সম্পাদক জাকারিয়া নোমান ফয়েজী, সংগঠনের নেতা হাবিব উল্লাহ, আহসান উল্লাহ, নুরুজ্জামান নোমানী, আব্দুল মতিন, মো. শহীদুল্লাহ, মো. রিজওয়ান আরমান, মো. নজরুল ইসলাম, হাসানুজ্জামান, এনামুল হাসান ফারুকী, মীর সাজেদ, জাফর আহমদ, মীর জিয়াউদ্দিন, আহমদ, মাহমুদ, আসাদউল্লাহ, জোবায়ের মাহমুদ, এইচ এম জুনায়েদ, আনোয়ার শাহ, আহমদ কামাল, নাছির উদ্দিন, কামরুল ইসলাম কাসেমী, মোহাম্মদ হাসান, ওবায়দুল্লাহ ওবাইদ, জুবায়ের, মোহাম্মদ, আমিনুল হক, রফিক সোহেল, মোবিনুল হক, নাঈম, হাফেজ সায়েমউল্লাহ ও হাসান জামিল। মামলায় সাক্ষী করা হয়েছে ছয়জনকে।
গত ১৮ সেপ্টেম্বর রাজধানী ঢাকার আজগর আলী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় হেফাজতে ইসলামের সর্বোচ্চ নেতা ও চট্টগ্রামের হাটহাজারী আল-জামিয়াতুল আহলিয়া দারুল উলুম মুঈনুল ইসলাম (বড় মাদরাসা) মাদরাসার মহাপরিচালক আল্লামা শাহ আহমদ শফী মারা যান।
এর আগে আল্লামা শফীর অব্যাহতি এবং তাঁর ছেলে মাদরাসার সহকারী পরিচালক আনাস মাদানির বহিষ্কার দাবিতে মাদরাসায় বিক্ষোভ করে শিক্ষার্থীদের একটি অংশ। সেই দ্বন্দ্বের জেরে ১৭ সেপ্টেম্বর শুরা কমিটির বৈঠকে অসুস্থতার কারণ দেখিয়ে মহাপরিচালকের পদ থেকে স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করেন ‘বড় হুজুর’ আল্লামা শফী। ওই বৈঠকে শফীর ছেলেসহ দুই শিক্ষককে অব্যাহতি দেওয়া হয়। এর মধ্য দিয়ে হাটহাজারী বড় মাদরাসায় দৃশ্যত আহমদ শফীর সুদীর্ঘ দিনের কর্তৃত্বের অবসান ঘটে।
সেই বৈঠকের পরপরই আহমদ শফীকে মাদরাসা থেকে অ্যাম্বুল্যান্সে করে পাঠানো হয় চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। সেখান থেকে ঢাকায় নেওয়া হলে পরদিন তিনি মারা যান। সেদিন ঢাকায় সাংবাদিকদের শফীপুত্র আনাস মাদানি বলেছিলেন, আগের দিনের ‘অনাকাঙ্ক্ষিত’ ঘটনার জেরে ‘টেনশনের’ কারণে ‘হার্টফেল’ করে তাঁর বাবা মারা গেছেন। পরে নেতৃত্বের প্রশ্নে হেফাজতে ইসলাম বিভক্ত হয়ে পড়ে এবং একাংশের সম্মেলনের মধ্য দিয়ে জুনাইদ বাবুনগরী আমিরের পদে আসেন।
মামলার আর্জিতে বলা হয়, আসামি মামুনুল হক এ বছরের ১১ থেকে ১৮ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত হাটহাজারী বড় মাদরাসায় এসে হেফাজতের বর্তমান আমির জুনাইদ বাবুনগরীর সঙ্গে বৈঠক করে আহমদ শফীর ছেলে আনাস মাদানিকে বহিষ্কারের দাবি করেন আহমদ শফীর কাছে। আহমদ শফী বিক্ষুব্ধদের লিখিত অভিযোগ দিতে বলেন। আনাস মাদানিকে বহিষ্কার না করলে হেফাজতের তৎকালীন আমিরের চরম ক্ষতি করা হবে বলে হুমকি দেওয়া হয় বিক্ষুব্ধদের পক্ষ থেকে।
এ সময় অসুস্থ আহমদ শফীকে বিক্ষুব্ধরা নানাভাবে বিরক্ত করেন এবং হুমকি দেন। ১৭ সেপ্টেম্বর আহমদ শফীকে হাটহাজারী বড় মাদরাসার মহাপরিচালক পদ থেকে পদত্যাগ করতে বলেন এবং অসুস্থ অবস্থায় তাঁর নাকে লাগানো অক্সিজেন নল খুলে ফেলেন বিক্ষুব্ধরা। এ সময় তিনি অজ্ঞান হয়ে পড়েন। তাঁকে হাসপাতালে নেওয়ার জন্য অ্যাম্বুল্যান্সে উঠানো হলে অ্যাম্বুল্যান্স মাদরাসা থেকে বের হতে দেয়নি আসামিরা। এসব কারণে চিকিৎসা পেতে বিলম্ব হয়েছে।
জানতে চাইলে হেফাজতের সহকারী সাংগঠনিক সম্পাদক মাওলানা মীর ইদরিস কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘মামলা হয়েছে বলে শুনেছি। পরে আনুষ্ঠানিকভাবে আমাদের বক্তব্য জানাব।