সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি এলাকা থেকে শিশু জিনিয়া অপহরণের ঘটনায় আলোচনায় উঠে আসেন নূর নাজমা আক্তার ওরফে লুপা তালুকদার। বর্তমানে যে নামটি দেশব্যাপী সমালোচিত। কিন্তু কে এই লুপা তালুকদার?
মাদকাসক্তসহ ব্যক্তিগত জীবনে বেপরোয়া চলাফেরা করা লুপার চারটি বিয়ের খবর পাওয়া গেছে। তিনি নিজেকে কখনও মানবাধিকারকর্মী, কখনও সাংবাদিক, কখনও আওয়ামী লীগ পরিবারের সদস্য। এ রকম নানা পরিচয়ের আড়ালে প্রতারণাই ছিল তার মূল পেশা।
চাকরি দেওয়ার নাম করে অনেকের কাছ থেকে হাতিয়ে নিয়েছেন লাখ লাখ টাকা। হত্যা মামলার আসামি লুপা নিজেকে আওয়ামী পরিবারের সদস্য দাবি করলেও তার বাবা একজন চিহ্নিত রাজাকার। লুপার বাবা হাবিবুর রহমান ওরফে নান্না তালুকদারসহ পরিবারের দুই সদস্য ১৯৭১ সালে শান্তি কমিটির সদস্য ছিলেন।
তবে সিনিয়র সাংবাদিক পরিচয়ে আওয়ামী লীগের কিছু নেতার সঙ্গে সখ্য গড়ে পুরো পরিবারই হয়ে গেছে ‘রাজনৈতিক মামলার শিকার আওয়ামী লীগ পরিবার’।
গৃহকর্মী ধর্ষণ ও শিশু সন্তানসহ হত্যার মামলায় তদন্তে সংশ্লিষ্টতা প্রমাণিত হওয়ার পরও মামলাটি ‘রাজনৈতিক বিবেচনার’ তালিকাভুক্ত করতে সক্ষম হন লুপা। পটুয়াখালী জেলার মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষ থেকে এমনটা দাবি করা হয়েছে।
স্থানীয় পর্যায়ে লুপার পরিচিতি অনেক বড় মাপের সাংবাদিক হিসেবে। তাদের ধারণা, গ্রামের স্কুলের এসএসসি পাস এই নারীর ক্ষমতার হাত অনেক লম্বা। ক্ষমতাধর অনেকের সঙ্গেই সম্পর্ক রয়েছে তার।
চাকরি, বদলি বা ঠিকাদারি কাজ- সবই তদবিরে পাইয়ে দিতেন লুপা। বিনিময়ে হাতিয়ে নিতেন টাকা।
জানা গেছে, মাত্র তিনদিনের মধ্যে চাকরি দেওয়ার কথা বলে পটুয়াখালীর মিজানের কাছ থেকে ২০১৮ সালে দুই কিস্তিতে লুপা হাতিয়ে নেন ১৩ লাখ টাকা। দিন, মাস বছর পেরিয়ে গেলেও চাকরি আর হয় না। পাওনা টাকা চাইতে গেলে উল্টো মেলে হুমকি। চাকরি দেওয়ার নামে এভাবেই অনেকের কাছ থেকে লুপা হাতিয়ে নিয়েছেন লাখ লাখ টাকা।
ভুক্তভোগী মিজানুর রহমান গণমাধ্যমকে বলেন, “তিনি বলেছিলেন- চাকরি দেওয়া তো আমার ওয়ান-টুর ব্যাপার বিভিন্ন মন্ত্রী আমার হাতের মুঠোয়। আমি সাংবাদিকদের সাংবাদিক।। দুইবারে ১৩ লাখ টাকা দেওয়া হয়েছে। এখন তা চাইলে জেলের ভাত খাওয়াবে বলে হুমকি দেয়।”
তার ফেসবুক প্রোফাইলে দেখা যায় তিনি অগ্নি টিভির ব্যবস্থাপনা পরিচালক। কাজ করেছেন বেশকটি গণমাধ্যমে। নিজেকে দাবি করেন আওয়ামী পেশাজীবী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির সাধারণ সম্পাদক বলে। বাগিয়ে নিয়েছেন জাতীয় পুরস্কারও।
এছাড়াও সিনিয়র রিপোর্টার নবচেতনা, সিনিয়র রিপোর্টার ও সিনিয়র ক্রাইম রিপোর্টার মোহনা টিভি, ডিরেক্টর শীর্ষ টিভি, ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সাপ্তাহিক শীর্ষ সমাচার এবং বাংলাদেশ কবি পরিষদের সদস্য হিসেবে ফেসবুকে উল্লেখ করেছেন তিনি।
তদন্তকারীরা জানান, গ্রেফতারের পর তিনি মোহনা টিভিতে একবার চাকরি করেছেন বলে একটি বিজনেস কার্ড দেখিয়েছেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি এলাকা থেকে পথশিশু জিনিয়া অপহরণ মামলায় গ্রেফতার হওয়ার পর লুপা তালুকদারের বিরুদ্ধে পুলিশের কাছে আসতে থাকে বিস্তর অভিযোগ। ২০০৩ সালে পটুয়াখালীর গলাচিপা থানায় লুপা ও তার পরিবারের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা হয়। ২০১৩ সালে ওই মামলার অভিযোগপত্র থেকে লুপা রাজনৈতিক বিবেচনায় রেহাই পান।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের যুগ্ম কমিশনার মাহবুব আলম বলেন, ‘লুপা তালুকদারের অতীতে তার বিরূদ্ধে একটা হত্যা মামলা ছিল। এছাড়াও তার বিরুদ্ধে আরও কিছু অভিযোগ রয়েছে সে বিষয়গুলো আমরা খতিয়ে দেখছি।’
এক বছর আগে হাতিরপুলের মোতালেব প্লাজার একটি বাসায় ভাড়া থাকতেন লুপা। গত বছর ওই বাসা থেকে লুপার এক ছেলের লাশ উদ্ধার হলে তিনি এটিকে আত্মহত্যা বলে দাবি করেন। লুপার বিরুদ্ধে হত্যা মামলা নিয়ে সংবাদ পরিবেশন করায় এক সাংবাদিকের বাবার বিরুদ্ধে মিথ্যা গুম মামলা দিয়ে হয়রানি করেন তিনি।
এছাড়া, ওই বাসায় ভাড়া বাবদ বাকি পড়েছিল ৪ লাখ টাকা। একসময় বাড়ি ছাড়তে বাধ্য হন তিনি।