মানুষের জীবনটাকে কতটা আমরা জানি। সবটাই কি অভিনয় নাকি সবটাই জীবন। একটা হাসিমুখ আমরা দেখি তবে সেই হাসিমুখের পিছনে মানুষের প্রতিদিনের জীবনের সাথে যুদ্ধটা কি আমরা দেখি। হয়তো দেখি না। মানুষের সেটা দেখার মতো যে একটা মন থাকতে হয় সেটা তো আমাদের অনেক আগেই মরে গেছে। যেমন সময়ের সাথে অনেক কিছুই মরেছে। সময়ের সাথে লাল চিঠির বাক্সটা এখন আবর্জনায় পরিণত হয়েছে। চিঠিটাও এখন ইতিহাস।
খট খট শব্দে আঙুলের বেদনায় আহত টাইপ রাইটার আর নেই। যে মানুষটা টাইপ রাইটার দিয়ে একদিন কালো অক্ষরের জাদুতে মাতিয়ে তুলতো মানুষকে সে মানুষটাও সময়ের সাথে কোথায় যেন হারিয়ে গেছে। কম্পিউটার মতো আধুনিক প্রযুক্তি এসে টাইপ রাইটারকে অপ্রচলিত পণ্যে পরিণত করেছে।
আগে গ্রামে যাত্রাপালা হতো। কত মানুষের ঘুম কেড়ে নিয়েছিল সে যাত্রাপালা। হায়, সেটাও তো আর নেই। একসময়ের মূল্যবান জিনিস আজকের সময়ে এসে মূল্যহীন হয়েছে। বায়োস্কোপ এখন আর চোখে পড়ে না। একটার পর একটা নির্বাক ছবি টেনে বায়োস্কোপওয়ালা আনন্দচিত্তে বলতেন, “এই বারেতে দেখা গেল, জরিনা সুন্দরী এলো।
কোমরেতে বিছা ছিল, কানে তাহার দুল ছিল। আহা কি চমৎকার দেখা গেল। কি চমৎকার দেখা গেল, আরও কিছু রইয়া গেল, তারা জ্যোতি চইলা গেছে, দেখতে কত বাহার আছে, এইবারেতে দেখেন ভাল, আপন রাজা সামনে আছে। তীর-ধনুক হাতে আছে।” মানুষকে আনন্দ দেবার সে মানুষটাও আর নেই।
একসময়ের দুরন্ত সময় আজ কেবল বিবর্ণ স্মৃতি। সময়ের সাথে সাথে মানুষ প্রযুক্তির জাদুকরী শক্তিতে বদলেছে। কিন্তু মাটির গন্ধও হারিয়েছে। সে মাটির গন্ধে বেগ হয়তো ছিল না তারপরও আবেগ ছিল। মনে পড়ছে পুতুল নাচের কথা। মানুষের অদৃশ্য আঙুলের নিপুণ কারুকাজে বোবা পুতুলগুলো নাচতো।
মানুষ যেভাবে চাইতো সেভাবে পুতুলগুলো আছাড়ি-বিছাড়ি করে নেচেছে। অদৃশ্য মানুষটা এখন আর নেই, যেমন নেই পুতুল নাচের সেই ফেলে আসা দিনগুলো। তবে পুতুল নাচ আমাদের জীবনবোধের সামনে এসে থমকে দাঁড়ায়। কখনো মনে হয় আমরাও যেন সেই পুতুলদের মতো নেচে চলেছি কোনো এক অদৃশ্য শক্তির আকর্ষণে। এমন করেই হয়তো শক্তির পিছনে শক্তি, তারও পিছনে শক্তি এ খেলায় মেতে উঠেছে। সবাই হয়তো তা জানে তবে বুঝতে পারে না।
সার্কাসের রং মেখে সং সাজা জোকারটার মুখটা খুব বেশি মনে পড়ছে। একটা কৃত্রিম হাসি মুখে ধরে রেখে জীবন যন্ত্রনায় জ্বলে-পুড়ে ছাই হওয়া মানুষটার ভিতরের বোবা আর্তনাদ বুকটাকে এখন কেমন যেন বুলেটবিদ্ধ করে যায়। জীবনকে বাজি রেখে জোকার নামের মানুষটা মানুষের মনোরঞ্জনের উপাদান হলেও তার ভিতরের কান্নাকে কেউ কখনো বুঝেও বুঝেনি। ১৯৭০ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত রাজ কাপুর পরিচালিত মেরা নাম জোকার সিনেমাটার কথা মনকে এসে নাড়া দিয়ে গেল। মেরা নাম জোকার ঋষি কাপুর অভিনীত প্রথম চলচ্চিত্র ছিল এবং এই চলচ্চিত্রটির কাহিনী সার্কাসের একজন জোকারকে নিয়ে গড়ে উঠে যেখানে তাকে সব দুঃখকে বুকে চাপা দিয়ে মানুষকে হাসানোর কাজ করতে হয়েছে।
এই জোকারের জীবনে তিনজন নারী আসে, তিনজন নারীই তাকে পছন্দ করে। কিন্তু কারো সাথেই তার সম্পর্ক টেকেনি। জোকার রাজু বুড়ো বয়সে তার জীবনে আসা তিনজন নারীকে চিঠির মাধ্যমে সার্কাসে আসার আমন্ত্রণ জানায় এবং তারা সবাই রাজুর সার্কাস দেখতে আসে। তখন জীবনের চার দেওয়ালে বন্দি হওয়া জোকার রাজু একটা গান গায়। যে গানটায় কষ্টগুলো বুকটাতে কেমন করে যেন আঁচড় দিয়ে যায়। একটা বিড়ম্বিত জীবনের আর্তনাদ যেন বৃষ্টির জল হয়ে অজান্তেই বেরিয়ে আসে এভাবে “জিনা ইহা ময়না ইহা ইসকে সেবা যানা কাহা….স্বর্গ এহি নরকে ইহা ইসকে সেবা যানা কাহা…..কাল খেল হাম হো না হো গার্দিস মে তারে রহেঙ্গে সদা”।
একটা জোকারের জীবন যেমন মানুষের জীবনটাও হয়তো তেমনি। জোকারের তো একটা রং মাখা মুখোশ থাকে। সেটা যেভাবে দেখা যায় যারা মুখোশ না পড়েও মুখোশের আড়ালে নিজেদের স্বার্থের খেলা খেলে তাদের চেনাটা খুব কঠিন। আগে জোকাররা মুখোশ পড়তো আর এখন শয়তানরা মুখোশ পড়ে। যে শয়তানরা নিজেদের মানুষ বলেও দাবি করে।
সাদাকালো সিনেমার সময় যে মানুষটার অভিনয় সিনেমাকে রঙিন করেছিল সে মানুষটার নাম চার্লি চ্যাপলিন। চার্লি চ্যাপলিন সেই মহান অভিনেতা যিনি বুকে কষ্ট চেপে দর্শকদের মুখে হাসি ফুটিয়েছেন। পরনে নাক সিটকানো কোট-টাই, ঢিলেঢালা জরাজীর্ণ প্যান্ট, মাথায় কালো রঙের ডার্বি হ্যাট, হাতে একটি পাতলা ছড়ি, পায়ে এবড়ো থেবড়ো এক জোড়া বুট এবং ঠোঁটের ঠিক উপরে খাটো গোঁফ মানুষটার। নিজের জীবনকে টুকরো কাচের আয়নায় দেখে উপহাস করে তিনি বলেছেন “এমনকি একটি জেলীফিশের কাছেও জীবন অনেক সুন্দর ও দারুণ একটা জিনিস”। চার্লি চ্যাপলিন সব সময় বলতেন তার মা’ই তার অনুপ্রেরণার উৎস ছিলেন। মায়ের মৃত্যুর আগ পর্যন্ত চার্লি চ্যাপলিন তাকে পরম যত্নে আগলে রেখেছিলেন; কোনো কষ্ট তাকে স্পর্শ করতে পারেনি।
অথচ তিনি আজীবন কষ্টকে ধারণ করে জীবনকে এগিয়ে নিয়েছেন। এখন তো সময় বদলেছে। মানুষ খুব কমার্শিয়াল হয়েছে। নিজের স্বার্থ নিয়ে যে মানুষরা প্রতিদিন একে অন্যের সাথে লড়ছে তারা কি মমতাময়ী মায়ের সেই ভালোবাসার মুখটা কখনো খুঁজেছে। না, তেমনটা ঠিক দেখছি না। মায়ের নাড়ি ছেঁড়া ধন সে নাড়ির টানকে গলা টিপে হত্যা করেছে। নিজে ক্রীতদাসের হাসি হেসেছে আর মায়ের হাসিকে বৃদ্ধাশ্রমের চার দেওয়ালে আটকে রেখে নিজের শেকড়কে লাথি মেরে ছুড়ে ফেলেছে পিচ ঢালা রাজপথে। সত্য মিথ্যার গল্পটা বার বার বলতে ইচ্ছে করে।
আমরা যেটা হাসি সেটা সত্য না মিথ্যা। নাকি সেটা একটা নগ্ন রহস্য। ফেলে আসা পুরাতন কিছু। হয়তো একটা মানুষ, তার পিছনের মানুষ, তার সামনের মানুষ, তার ভিতরের মানুষ সবকটাই একটা মানুষ তবে অভিন্ন মানুষ নয়। যেমন যে সত্যকে আমরা দেখি তা হয়তো সত্য নয়। যা দেখি না সেটাই সত্য। মানুষের বাইরের শরীরের চেয়ে যেমন ভিতরের হাড় দিয়ে গড়া কংকালটা সত্য। রামায়ণ রচনা প্রসঙ্গে মহর্ষি বাল্মীকিকে নিয়ে রবীন্দ্রনাথের ‘ভাষা ও ছন্দ’
কবিতার দুটি লাইন:
নারদ কহিল হাসি, ‘সেই সত্য যা রচিবে তুমি,
ঘটে যা তা সব সত্য নহে।
সত্য এমন আগুনে পোড়া নদীর মতো। জলীয় বাষ্পের মতো। মেঘে ঢাকা তারার মতো। যার গতিপথ জীবনের গতিপথকে হার মানায়।
একটা বিখ্যাত চিত্রকর্মের ভাবার্থ মনে পড়লো। যেখানে বলা হচ্ছে যেটাকে আমরা সত্য বলে চোখে দেখছি সেটা নাকি সত্য নয়, সত্যের মুখোশ পড়া মিথ্যে। এ প্রসঙ্গে ফরাসি একজন চিত্রকর জিনলেওন জেরোমের ১৮৮৬ সালে আঁকা বিখ্যাত একটি ছবি he truth is coming out of the well -এর বিষয়বস্তুকে টেনে আনা যায়। উনিশ শতকের একটি লোককথাকে ভিত্তি করে ছবিটি আঁকা হয়েছিল। গল্পটা ছিল এ রকম: একবার সত্য ও মিথ্যা পরস্পরের সঙ্গে দেখা করল কিছু বিষয় মীমাংসার তাগিদে। হাঁটতে হাঁটতে তারা চলে গেল একটা কুয়ার পাশে।
মিথ্যা বলল, দেখ, কী পরিষ্কার পানি। চল গোসল করি। বলাবাহুল্য, সত্য বিশ্বাস করেনি মিথ্যার কথা। নিজে পরখ করে দেখল। যখন দেখল কুয়ার পানি সত্যিই পরিষ্কার তখন মিথ্যার প্রস্তাবে রাজি হল। দুজনে পোশাক ছেড়ে নেমে পড়ল কুয়ায়। গোসলের মাঝপথে মিথ্যা কুয়া থেকে উঠে এসে সত্যের পোশাক পরে পালিয়ে গেল।
খানিকক্ষণ অপেক্ষা করার পর মিথ্যাকে ফিরতে না দেখে সত্য উঠে এল কুয়া থেকে। না, মিথ্যা তো কোথাও নেই, পোশাকও নেই। রাগে অন্ধ হয়ে সত্য বের হল মিথ্যাকে খুঁজতে কিন্তু নগ্ন সত্যকে দেখে ছি ছি করল সভ্য মানুষ। এমনকি তেড়েও এল অনেকে। সত্য অনেক চেষ্টা সত্ত্বেও তাদের বোঝাতে না পেরে রাগে-দুঃখে অপমানে ফের কুয়ায় নেমে গেল। তারপর থেকে সত্যকে আর কখনো কেউ দেখেনি। যাকে দেখেছে কিংবা দেখছে সে সত্যের পোশাক পরা মিথ্যা।
সব কিছু মানুষের আজ কেমন করে যেন হারিয়ে গেছে। এক একটা মানুষ জীবন্ত লাশ হয়ে রাজপথের কোলাহলে নিজেদের অস্তিত্ব হারাচ্ছে। ঝুলন্ত বাদুড় হয়ে সত্য মিথ্যার পোশাক পড়ে মানুষের বিবেক বিক্রি হচ্ছে প্রতিদিন। তাও খুব চড়া দামে। তারপরও সব হারিয়েও জীবনবোধের বিশ্বাস তো কখনো হারাতে নেই। আবেগ তো কখনো হারাতে নেই। স্বপ্ন জয়ের হাসি তো কখনো হারাতে নেই। প্রতিদিন মানুষের মৃত্যুর খবর যেমন আসে তেমনি নবজাতকের ভূমিষ্ঠের খবরও আসে। সব পুরাতন পচে যায় না। নষ্ট হয়ে নষ্টের দড়িতে ঝুলে পড়ে না।
যেমন সময়। যেমন সততা। যেমন মানবিক মূল্যবোধ। এমন আরও অনেক মূল্যহীন মানুষের বাজারের অনেক অদেখা মূল্যবান জিনিস। চলন্ত ট্রেনটা মানুষকে পিষে ফেলার আগেই মানুষ সেখান থেকে বেরিয়ে আসুক। সব মানুষ রক্ত মাংসের মানুষ হোক। যেমন মানুষ, মানুষ তেমনটাই থাকুক। সবটাই এক ঝাপটায় মানবিক নগর হয়ে উঠুক মানুষের অতৃপ্ত যন্ত্রনায়। সেটা চোখে না দেখে মন দিয়ে দেখাটাতেই আনন্দ। তার থেকে বেশি কিছু নয়।
অনৈতিক আচরণের মাধ্যমে শিশুকে যৌন উৎপীড়ন করা হয়ে থাকে। দারিদ্র্যতা কিংবা অতি প্রাচুর্য, কুসঙ্গ, অপসংস্কৃতি, স্যাটেলাইট সংস্কৃতির কু-প্রভাব, ধর্মীয় মূল্যবোধের অভাব, কর্মমুখী পিতা-মাতার অনাদর ইত্যাদির কারণে শিশুরা অপরাধী হয়ে উঠছে।
শিশু-কিশোর অপরাধ নিয়ন্ত্রণে পুলিশের ভুমিকা শিশু আইন ১৯৭৪ কিশোর অপরাধীদের প্রতি পুলিশের ভুমিকা নির্ধারণ করা হলেও তা যে যথাযথভাবে পালন করা হয় না, তার প্রমাণ হাইকোর্টের আদেশ। এ সম্পর্কিত আইনের ৭২ ধারায় স্পষ্ট বলা হয়েছে যে, আটককৃত শিশুর প্রতি প্রহরারত পুলিশ পিতৃসুলভ ব্যবহার করবেন এবং তার প্রতি যত্নশীল হবেন। ৫০ ধারা অনুযায়ী শিশু বা কিশোর অপরাধীকে আটকের পর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা অবশ্যই জেলা প্রবেশন কর্মকর্তাকে তা অবহিত করবেন। ৪৮ ও ৪৯ ধারা অনুযায়ী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা কিশোর অপরাধীকে মুক্তি দিতে পারবেন। তবে যে ক্ষেত্রে তা সম্ভব না হবে সেক্ষেত্রে শিশুকে নিরাপদ স্থানে হেফাজতে রাখবেন।
৪৬ ধারা অনুযায়ী শিশু আইনের ধর্তব্য অপরাধগুলোর সংবাদ থানায় পৌঁছলে ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মামলা রুজু করবেন এবং প্রয়োজনীয় তদন্তের ব্যবস্থা নেবেন। ১৩ ধারা অনুযায়ী কোনো শিশুকে আদালতে সোপর্দ করা হলে সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তার দায়িত্বে শিশুর অভিভাবককে লিখিতভাবে তা অবহিত করা এবং নির্ধারিত তারিখে অভিভাবক যাতে আদালতে উপস্থিত থাকতে পারেন তা নিশ্চিত করতে হবে। ৩ ও ৪ ধারা অনুযায়ী শিশু অপরাধীদের সর্বদা কিশোর আদালতে সোপর্দ করতে হবে। ২ ধারা অনুযায়ী অনুর্ধ্ব ১৬ বছরের শিশুকিশোরকে আইন মোতাবেক শিশু বলা হয়েছে।
এছাড়াও পি আর বি রোল ৫২১ এর নির্দেশ মোতাবেক কিশোর অপরাধীর মুক্তির পর পুলিশ কর্মকর্তা তাকে বাড়িতে পৌঁছে দেবেন। দুজন গণ্যমান্য ব্যক্তির উপস্থিতিতে শিশুটিকে তার অভিভাবকের কাছে হস্তান্তর করবেন।
শিশু অপরাধীদের জন্য টঙ্গী ও যশোরে সংশোধনাগার রয়েছে। পরিকল্পিত কর্মসূচির অধীনে তাদের প্রশিক্ষণ, শিক্ষা ও হাতে কলমে কাজের মাধ্যমে সংশোধন করার ব্যবস্থা নেওয়া হয়ে থাকে।
কিন্তু পুলিশ বয়স্ক অপরাধীদের সঙ্গে যে আচরণ করেন, সেই একই আচরণ শিশু অপরাধীদের সঙ্গেও করেন। ফলে উদ্রেক করে নানা প্রশ্নের। বরিশালে চার শিশুর ক্ষেত্রে যে আচরণ লক্ষ্য করা গেছে।
রামিম রাফি, মিডিয়া গ্রুপ লিমিটেড। যোগাযোগ এডিটর, +8802478835086, ফোনঃ বার্তা প্রধান +8801713932564, সিইও আমির হোসেন। +8801746371260, ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোঃ লোকমান মৃধা। 01717966305, Emil: sadhinbanglatv52@gmail.com






